বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর 'চাঁদের পাহাড়'



“মানুষের আয়ু মানুষের জীবনের ভুল মাপকাঠি”

কথাটা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর 'চাঁদের পাহাড়' উপন্যাস হতে নেয়া। সত্যি তাই, মানুষের আয়ু কখনো তার জীবনের মাপকাঠি হতে পারে না। হাজার কিংবা শত বছর বেঁচে থেকেও অনেকে কিছুই করতে পারেনা, আবার অল্প কিছুকালের জন্য পৃথিবীতে আসা কিছু মানুষ আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। অমর হওয়ার জন্য জীবনের বৈচিত্র্যতা অর্জন করতে হয়,আর সেজন্য স্বপ্ন থাকতে হয়, ত্যাগ থাকতে হয়।

উপন্যাসের নায়ক শঙ্কর তেমনি এক স্বপ্নবাজ যুবক। যার মন উড়ে যেতে চায় পৃথিবীর দূর, দূর দেশে- শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে।

সময়কাল ১৯০৯, সদ্য এফ এ পাশ করে গ্রামে এসেছে শঙ্কর।বাবার অসুখ আর সংসারের দারিদ্রের মাঝে মায়ের অনুরোধ পাটকলে চাকরি নেয়ার জন্য। ফুটবলের নামকরা সেন্টার ফরওয়ার্ড, জেলার হাই জাম্প চ্যাম্পিয়ন, নামজাদা সাতারু শঙ্করকে হতে হবে পাটকলের বাবু? হ্যারি জনস্টন, মার্ক পোলো, কিংবা রবিন্সন ক্রুসোর মত জীবন কাটানোর স্বপ্ন কি তবে দুরাশা?
না, স্বপ্নবাজদের স্বপ্ন কখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না।

ঘটনাক্রমে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে শঙ্করের চাকরি জুটে রহস্য, এডভেঞ্চার আর রোমাঞ্চের দেশ আফ্রিকার উইগান্ডার রেলওয়েতে। আর সেই চাকরি জীবনেই ঘটতে থাকে যতসব লোমহর্ষক ঘটনা! সেই লোমহর্ষক গল্পের শুরু হয় আফ্রিকার অদম্য সিংহের নরমাংস ভক্ষনের ভীতিকর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। শঙ্করের কর্মস্থল থেকে এক এক করে অনেক মানুষকেই ধরে নিয়ে যেতে থাকে নরমাংস খেকো সিংহ। এরপর বদলি হয়ে এক ছোট্ট স্টেশনে স্টেশন মাস্টার হিসেবে যোগ দেয় সে। স্টেশন ঘরটা খুব ছোট, প্ল্যাটফর্ম আর স্টেশন ঘরের আশপাশ কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আগের জায়গার তুলনায় এই জায়গাটা অনেক নিরাপদ, তাই না?

না, মোটেই নিরাপদ না! কারন এবার সিংহের সাথে যোগ হল সাপের উপদ্রব।তাও যেনতেন সাপ না- আফ্রিকান কালো মাম্বা। ভাবুনতো, অন্ধকার মাঝ রাতে আপনার বিছানার পাশে উদ্যত ফণা তুলে দাড়িয়ে আছে হিংস্রতম ব্ল্যাক মাম্বা! যেটার প্রতি ছোবলে ১৫০০ মিলিগ্রাম তীব্র বিষ শিকারের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

একসময় শঙ্করের দেখা হয় ডিয়েগো আলভারেজ এর সাথে। লাল দাড়ি আর বড় বড় চোখের এ মানুষটি ১৯৮৮/৮৯ সালের দিকে কেপ কলোনির উত্তর পাহাড়ের জঙ্গলে খুজে বেরিয়েছেন সোনার খনির সন্ধানে। একসময় খনির সন্ধান পেয়েও তা আর জয় করতে পারেন নি।তাই আবার বেরিয়েছেন নতুন করে। শঙ্কর কে সহযাত্রী হওয়ার প্রস্তাব করে সে, শঙ্করও রাজি হয় সাথে সাথে।

গল্পের মূল কাহিনির শুরু এখান থেকেই। এরপর রুদ্ধশ্বাস অভিযান, লোমহর্ষক ঘটনাক্রম, কষ্ট, সাহস, বীরত্ব আর বন্ধুত্বের নানা উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাসের কাহিনী! শেষ পর্যন্ত কি পরিনতি হয়েছিল তাদের?

শুধু এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আপনাকে এই বইটি পড়তে অনুরোধ করবোনা বরং অনুরোধ করব আর অনেক কারনে। আমার মতে, সাহিত্যের সার্থকতা হল গল্পের চরিত্রের মাঝে পাঠককে প্রবেশ করানো। এদিক দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শতভাগ সফল। যিনি কখনো আফ্রিকায় যান নি, কেবলমাত্র বই পত্র পড়ে আর ম্যাপ ঘেঁটে অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে এক অসাধারণ লেখনির মাধ্যমে আপনাকে নিয়ে যাবে আফ্রিকার গভীরে, সাভানা আর নিঝুম অরণ্যের গোলক ধাঁধার ভেতর দিয়ে।মাঝ রাতের আকাশে তারাদের ঝকমকে সৌন্দর্য কেবল শঙ্করকে না, আপনাকেও মুগ্ধ করবে!

সিংহ, বেবুন, বুনিপ নামের হিংস্র জন্তু, বৃষ্টি, অগ্ন্যুৎপাত কে উপেক্ষা করে আকাশচুম্বী পর্বতমালা “রিখটারসভেল্ড রেঞ্জ” পাড়ি দিয়ে সেই হীরার খনির সন্ধানে ডিয়েগো আলভারেজ আর শঙ্করের সঙ্গী হতে আপনাকে সাদর আমন্ত্রন!

হ্যাপি রিডিং!

Comments

Popular Posts

'নক্সী কাঁথার মাঠ' - বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন

নুরুল মোমেন এর বিখ্যাত নাটক 'নেমেসিস'

শওকত ওসমানের কালজয়ী গ্রন্থ - 'ক্রীতদাসের হাসি'